কলিংবেলের উপর ছোট্ট কাগজের টুকরায় লাল সাইনপেন দিয়ে ইনভার্টেড কমার ভেতরে ক্রস চিহ্ন আঁকা। শ্যাওলা রঙের তিনতলা বিল্ডিং এর ধূসর গেটটা অতিকায় আকৃতির।নোনা জলের একটা ছোট স্রোত তিতিরের কপাল বেয়ে কমলা জামাটায় গড়িয়ে পড়লো। অতিরিক্ত গরম পড়েছে। এই বাসায় বাচ্চা পড়ানোর মাঝে দুটো চমৎকার ব্যাপার রয়েছে। এক নম্বর হচ্ছে বাচ্চার টেবিলে গিয়ে বসা মাত্র এক গ্লাস ঠান্ডা পানি চলে আসে। দুই নম্বর টা একটু বেশি চমৎকার অবশ্য। মাসের শুরুতেই ভারী বাদামী খামটা পাওয়া যায়। এই বাসায় বাচ্চা পড়ানোর একটা বাজে ব্যাপার ও রয়েছে। তাদের কলিংবেল কাজ করে না। তিনতলা বাসার পুরোটা মিলিয়েই তারা থাকে। তাদের টাকা পয়সার ও কোন কমতি নেই। কিন্তু কলিংবেল ঠিক করতে তাদের এত কষ্টের কি হেতু তিতিরের মাথায় ঢুকে না।
তিতির ব্যাগ থেকে রূমাল বের করলো। আজকাল কেউ রূমাল ব্যবহার করে না। কিন্তু তিতির করে। কারণ তিতিরকে রূমালটা দিয়েছে অর্ণব। অর্ণবের কান্ড জ্ঞান মোটামুটিভাবে শূণ্যের কাছাকাছি। রূমাল দিলে ঝগড়া হয় এই আজব তথ্য শোনার পর সে তিতিরের জন্য নিজ দায়িত্বে ক্যাটক্যাটে সবুজ বর্ডার দেয়া একটা রূমাল উপহার হিসেবে নিয়ে এসেছিলো। উদ্দেশ্য তিতিরের সাথে ঝগড়া করবে। তিতিরের সাথে তার কখনোই ঝগড়া হয়না। অর্ণবের ফোনে তিতিরের নাম সেভ করা ধৈর্যবতী দিয়ে। যে মেয়ে ভীষণ মেজাজ খারাপ করা কাজ কারবার ও অসীম ধৈর্য নিয়ে তার নাম ধৈর্যবতী হওয়াই বাঞ্ছনীয়। তিতির রূমাল পেয়েও ঝগড়া করে নি। মাশিয়াদের ব্যাপারে জানার পরেও না। অর্ণবের সাথে পরিচয়ের পর তিতির নিজের সাথেই ওয়াদা করেছিলো। অর্ণবের উপর সে কোনদিন রাগ করবে না। অর্ণবের সাথে পরিচয় কিংবা সম্পর্কের পুরো জার্নিটা হবে সুন্দর। এলি আর কার্লের মতো। আপ মুভিটা তিতিরের খুব পছন্দের ছিলো। এলি আর কার্লের মত ছোট ছিমছাম দুজনের সংসার করার অংশটুকু কতবার তিতির টেনে টেনে দেখেছে।
পুরোনো বাড়ির গেট খোলার সময়তেই কিচকিচে আওয়াজ তুলে। বাচ্চাটার আজ পরীক্ষা নেবার কথা ছিল। ঘরে বসতেই রহিমা খালা এসি ছেড়ে দিয়ে গেলো। এই বাসায় যত্ন আত্তি বেশ। বুনকো বুনকো ঠান্ডা হাওয়া এসে ঘাড় গলায় লাগছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হীমশীতল এক গ্লাস পানি চলে আসবে। মাঝখানে কি একটা চল হলো, রাস্তায় ভ্যান গাড়ির উপর ফিল্টার বসিয়ে লেবুর শরবত বিক্রি করা। এক গ্লাস পাঁচ টাকা। তিতিরের কাজ ছিলো ক্লাস থেকে বেরিয়েই এক গ্লাস লেবু শরবত কিনে ফেলা। শরবতটা খাবার পর একদম কলিজা সহ ঠান্ডা হয়ে যায়। অর্ণবের ক্লাস না থাকলে সেও শার্টের হাতা গুটিয়ে শরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে কেন যে এই নোংরা জিনিসটা তোমার এতো পছন্দ বলতে বলতে ছোট ছোট চুমুক দেয়া শুরু করতো। অর্ণবের সাথে তিতিরের ঘুরতে কি ভালো লাগতো? তিতির বেশ খানিকটা ইন্ট্রোভার্ট মেয়ে। প্রথম যেদিন অর্ণবের সাথে রিকশা জার্নি হলো, তিতিরের পেটের ভেতর একশ প্রজাপতির কাঁপন ছিলো। তিতির লজ্জাতে কথাই বলতে পারছিলো না আর অর্ণব হাত নাড়িয়ে মুখের কথাতেই রাজা উজির মেরে শেষ! রিকশা কার্জন হলের গেটে থামলে অর্ণব হুট করে তিতিরের হাত ধরে। আপনি এতো কাঁপছেন কেন? অর্ণবের কান্ডজ্ঞান একদম শূণ্যের কাছাকাছি।তা নাহলে এমন কেউ করে?
অর্ণবের ইতস্তত পাগলামি, পুরুষালি কন্ঠ, রবীন্দ্রপ্রেম কি দেখে এতো মুগ্ধ হয়েছিলো তিতির? বলা হয়ে থাকে ভালোবাসার কোন কারণ থাকে না। তিতির কেন অর্ণব কে ভালোবাসে এর কারণ আজ ও খুঁজে পায়নি। অর্ণবের মধ্যে কেয়ারিং ব্যাপারটা কম ছিল অথবা ব্যাপারটা হয়তো এমন ছিল অর্ণব কেয়ারিং শো করাটাই পছন্দ করে না। তিতিরের অনেক কথাই অর্ণব মনোযোগ দিয়ে শোনেনি কিংবা সেটা মনে রাখার তাগিদ বোধ করে না এই ব্যাপারটা প্রথম নোটিশ করার পর তিতির একটু দমে গিয়েছিলো। কলেজ লাইফে ওর বন্ধুরা দুদ্দাড় প্রেম করতো। ক্লাস শেষ হলে তাদের কারো কারো বয়ফ্রেন্ডরা ভারী ব্যাগটা নিজেদের কাঁধে নিয়ে নিতো। অর্ণব কে ও এমন কখনো দেখেনি। কিন্তু যেদিন রাস্তায় ও রিকশার সাথে এই একটুর জন্য ধাক্কা খেতে নিলো, অর্ণব তাকে ঠেলে বাম পাশে পাঠিয়ে দিয়ে মুখ ভেংচে বলেছিলো রিকশা তো ভেঙ্গে ফেলবে। তিতির সেদিন একরাশ ভালো লাগা নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলো। অর্ণব আর সবার মতো নয়, অর্ণব নিজের মতো করেই তিতিরের কেয়ার করে। দুজনের যতটা কথা ছিলো তার চেয়ে বেশি ছিলো খুনসুটি। কথার মারপ্যাঁচে কুপোকাত করতে করতে হাল ছেড়ে দিলে মাঝে মাঝে তিতির মুখ টিপে হাসতো। হাল ছেড়ে দেয়ায় নয়, তিতিরকে হারিয়ে দিয়েছে তাই ভেবে অর্ণবের দিগ্বিজয়ী হাসি দেখে।
অর্ণবের দেয়া প্রথম উপহার ছিলো বই, দ্বিতীয় উপহার শাড়ী। তিতির অনেকদিন থেকে একটা ভীষণ মায়া মায়া নীল শাড়ী কিনতে চাচ্ছিলো। আজিজ পুরোটা চষে দেশালের যে শাড়ীটা ওর খুব ভালো লেগে গেলো, তা আর দামে বনেনি। অর্ণব খুঁজে খুঁজে সেই শাড়ীটাই ওর জন্য কেমন করে যেন নিয়ে এলো। তিতির বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলো অর্ণবের সাথে তার পরিচয় ব্যাপারটা মিরাকল নয়। ঈশ্বরের নিশ্চয় কোন প্ল্যান আছে। ঈশ্বর সেদিন উপর থেকে মুচকি হেসেছিলেন। অবশ্যই হেসেছিলেন।
অর্ণবের সাথে কাটানো সময় গুলো কেমন উড়ে উড়ে পালাতো। বৈশাখে সবাই যখন লাল সাদা নিয়ে টানাটানিতে ব্যস্ত তিতির সেদিন নীল পড়লো। অর্ণবের কেনা নীল শাড়ি। অর্ণবের সাথে প্রথম বৈশাখ। অর্ণবকে সেদিনই তিতির প্রথম জিজ্ঞাসা করেছিলো আমার আগে তোমার জীবনে কেউ এসেছে? স্বভাবমতো অর্ণব কথাটাকেই উড়িয়ে দিয়েছিলো। ধ্যাত ওরকম কিছু হলে বলতাম না তোমাকে? তিতির তখন স্বস্তির শ্বাস ফেলে। তিতির কি একটু ট্যিপিকাল? তিতির কি একটু গেঁয়ো? অর্ণবের কারো সাথে পরিচয় থাকলে কিছু কি যেতো আসতো? তিতিরের মন উত্তর দিয়েছিলো না। তিতির অতীত নিয়ে ভাবে ঠিকই কিন্তু অতীতে বসে থাকে না। তিতিরের অর্ণবের মাঝে বন্ধুকে খুঁজতো। এমন একজন বন্ধু যাকে সব বলা যায়, যে নিজেও লুকোয় না কিছু।অর্ণব লুকিয়ে রেখেছিলো। অর্ণব কি স্বন্তপর্ণে মাশিয়াদ কে লুকিয়ে রেখেছিলো! মাশিয়াদ পৃথিবীর দশটা ভালো মেয়ের একটা মাশিয়াদ, দশটা মায়াবতীর একজন মাশিয়াদ যাকে দেখলেই মন ভালো হয়ে যায় তাকে অর্ণব কি যত্ন করে লুকিয়ে রেখেছিলো!মাশিয়াদ অর্ণবকে তার জীবনে পেয়ে কি অসাধারণ খুশিটাই ছিলো। মাশিয়াদের জীবনে ঘটে যাওয়া শ্রেষ্ঠ ব্যাপারটাই যে ছিলো অর্ণব। I am lucky to have you in my life.একটা মেয়ে নিজেকে কতটা ভাগ্যবতী ভাবলে এমন করে বলে...
মাশিয়াদকে জানার পর তিতির সরে এসেছিলো। উঁহু ওর একটুও রাগ হয়নাই। এরকমটা যেন হতেই পারতো। অভিমান যে হয়নি তিতির তা বলবে না। কৈশোর থেকে তিতিরের বুকে একটু একটু করে জমিয়ে রাখা আবেগ একটা ভুল মানুষের কাছে জিম্মি হয়ে গেলো এই অভিমানে তিতির কেঁদেছিলো। খুব কেঁদেছিলো। Trance act কি তিতির প্রথম বুঝলো। মস্তিষ্ক মনের আওতায় চলে গেলো পুরোপুরি। বারান্দায় বসে থাকলে নীল রঙ করা পাশের বাড়ির দেয়ালের মাঝে অর্ণবের দেয়া নীল শাড়ী দেখতে পেতো। ছায়ানটের লাল দালানের সামনে যেন সাদা পাঞ্জাবীতে অর্ণব দাঁড়িয়ে, কার্জন হলের সামনে রিকশা থেমে গেলে তিতির চমকে চমকে উঠতো। অর্ণব নিজে থেকে কখনো ফিরে আসে নি। তিতিরের দুজনার সংসারের স্বপ্নের গল্পটা একটা হাইফেন হয়ে রইলো।
হিম শীতল পানির গ্লাসটা নিয়ে এক ঢোঁকে সবটা শেষ করলো তিতির। তিতির সময় দেখলো।এখানে দেড় ঘন্টার পড়ানো শেষ করে আরেক বাসায় যেতে হবে। তিতির আজকাল বেশ ব্যস্ত থাকে।সব কিছুর পরেও জীবন তো নিজের নিয়মে চলতেই থাকে তাইনা? চলতে তো হবেই। The show must go on…

No comments:
Write comments